রোমান্টিক গল্প বাংলা (মল্লিকাবনে)

 রোমান্টিক গল্প বাংলা (মল্লিকাবনে)



' ছড়া কে এই ক্লাসে? যে-ই হও না কেন মাস্টার্সের সাফওয়ান ভাইয়ার সাথে গিয়ে দেখা করো। কুইক!'


আমি নয়নের থেকে গতকালের কিছু নোটস্ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ক্লাসে একটা ছেলে এসে আমার নাম ধরে ডাকাতে যতটা না অবাক হলাম তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলাম সাফওয়ান ভাইয়ার কথা বলায়। মাস্টার্সের সাফওয়ান ভাইকে সবাই চেনে। পড়ালেখায়, আচার-আচরণে দুর্দান্ত হওয়াতে স্যার ম্যামদের প্রিয় পাত্র। এবার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। রেজাল্ট বের হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। সবার ধারণা তিনি সিজিপিএ ফোর পাবেন। তাকে ভার্সিটির মুখপাত্র বললে ভুল হয় না। সাফওয়ান ভাই সবার কাছে একজন আকর্ষণীয় মানুষ। রাজনীতিতে  সরাসরি তিনি না থাকলেও আমাদের ভিপি তার পরামর্শেই চলে দেখে সবাই তাকে আরো বেশি সমীহ করে চলে। শোনা গেছে ভিপির পদ তিনিই পেতেন কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে সব ছেড়ে দেন। আগে অবশ্য রাজনীতিতে বছর দুয়েক বেশ ভালোই সক্রিয় ছিলেন। সবই শোনা কথা। আমি নিজ চক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি। কারণ আমি ভার্সিটিতে মাত্র দুই বছর হলো আছি। সেইসব আরো তিন চার বছর আগের কথা। তবে তার হঠাৎ আমাকে কি জন্যে দরকার তা-ই বুঝতে পারলাম না।


আমি প্রথমবার যখন তাকে দেখেছিলাম বেশ অবাক হয়েছিলাম। কেননা অতি সুদর্শন যুবক তিনি। গায়ের রঙ সাধারণত আমাদের দেশের মানুষের এত ফর্সা হয় না। তারউপর তার চোখটাও আশ্চর্য সুন্দর। হালকা নীল বর্ণের চোখ দেখে আমি প্রথমেই ভেবেছিলাম লেন্স লাগায়। আমার বদ্ধ ধারণা বড়লোকের ছেলে পেলেরা বেশ ঢং চং করে চলে। এই ভুল অবশ্য ভাঙে ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে। জানতে পারলাম সাফওয়ান ভাইয়ের রূপের র'হ'স্য নিয়ে। তার সৌন্দর্যের পেছনের আসল কারণ তার ইরানী মা। হ্যাঁ, সাফওয়ান ভাইয়ার মা হলেন ইরানের অধিবাসী। তবে তার বংশ ইউকেতে শিফট্ হয়। সাফওয়ান ভাইয়ার বাবা ইউকেতে পড়ালেখা করতে যাওয়ার পর তার সাথে পরিচয়। তারপর প্রেম এবং বিয়ে। শুনেছি তিনিও অতি সুন্দরী মানবী। দেখার সুযোগ অবশ্য আমি পাইনি। তবে ইচ্ছা আছে একবার একটু তাকে কাছ থেকে দেখার। 


ক্যান্টিনে গিয়ে পাবলুর কাছ থেকে জেনে নিলাম সাফওয়ান ভাইয়ার খবর। আপাতত তার অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিলাম। পাবলু হলো ভার্সিটির দিক নির্দেশক। কে, কখন, কোথায় থাকে সব তার কাছে গেলে জানা যায়। চা নিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে সে সবার বসার জায়গা গুলো সম্পর্কে ভালোই অবগত। আর যদি সাফওয়ান ভাইয়া হয় তবে তো কথাই নেই। বললাম না, তাকে নিয়ে সবার আলাদা রকমের মাতামাতি রয়েছে!


চারুকলা ভবনের দোতলায় কর্ণারের রুমটায় যখন গিয়ে পৌঁছালাম দেখলাম সাফওয়ান ভাইয়া সহ আরো রয়েছে তিনটা মেয়ে আর চারটা ছেলে। তাদেরকে দেখলাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে নয়তো কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি একটা দল নিয়ে একটা আড্ডা চলছিল তা বেশ ভালোই বোঝা গেল। কিন্তু এই আড্ডাখানায় আমার তলব হলো কেন সেটাই বুঝতে পারলাম না। 


আমি ক্লাসে ঢুকতেই একটা মেয়ে বলে উঠলেন,

-'এই মেয়ে! কে তুমি? এখানে কেন এসেছ?'

-'জ্বি, আমাকে ডাকা হয়েছিল। বলল সাফওয়ান ভাইয়া ডেকেছেন।'

-'ওহ! তাহলে তুমিই ছড়া?'

-'হ্যাঁ।'


সাফওয়ান ভাইয়া এতক্ষণ ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেও এবার আমার দিকে ফিরলেন। সরাসরি তার চোখে চোখ পড়ল আমার। সাফওয়ান ভাইয়াকে আজ অন্যরকম লাগছে। ক্লিন শেইভ করা অবস্থায় আমি বোধ হয় এই প্রথম তাকে দেখলাম। আমি আমার জীবনে যা করিনি তা আজ প্রথম করলাম। আমি বে'হা'য়া'র মতোন ড্যাবড্যাব করে সেই তীক্ষ্ণ চাহনির, শক্ত চোয়ালের অধিকারী পুরুষের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। পাশের থেকে একটা মেয়ে তা দেখেই বোধ হয় ধ'ম'কে উঠল। বলল,

-'এই মেয়ে! এমন ড্যাবড্যাব করে কি দ্যাখো? চোখ নামাও। সিনিয়রকে চোখ তুলে দেখার সা'হ'স পাও কোথায়?'


আমি মনে করতে পারলাম না এমন কোনো সংবিধান যেখানে সিনিয়রকে চোখ তুলে দেখায় মানা আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি এবার মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে রইলাম। তখনিই কারো গলা ঝারার শব্দ পেলাম। সামনে তাকাতেই দেখলাম সাফওয়ান ভাইয়া এগিয়ে এলেন। বললেন,

-'তা তোমার নাম সত্যিই ছড়া? ছড়া আবার নাম হয় নাকি!'


ভরাট কন্ঠস্বরটা শুনতে আলাদা রকমের এক তৃপ্তি বোধ হলো। তবুও তার কথাটা কোনো ভাবেই হজম করার মতো নয়। বললাম,

-'হয়। আপনি হয়তো শোনেন নি কখনো।'

-'তাই নাকি? আমি শুনিনি! এই তোরা কেউ শুনেছিস?'


শেষের কথাটা বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল। সবাই একসাথে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ কেউ শোনেনি। সাফওয়ান ভাইয়া বললেন,

-'কেউই তো শোনেনি। যাই হোক! তুমি নাকি খুব ভালো সিনিয়রদের সম্মান দিতে জানো। দেখি তো, আমাদের একটু সম্মান করো।'


আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সম্মান করব মানে? সম্মান করার জন্যই কি আমাকে ডেকে এনেছে? আমি চুপ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনিও অবিচল ভাবে আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছেন। অ'স্ব'স্তিতে আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম।


তখনিই একটা মেয়ে হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকল। আমি তাকে দেখে অবাক হলাম। এই মেয়ের সাথে গতকাল আমার একটু কথা কা'টা'কা'টি হয়েছিল। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে মেয়েটি। অত্যন্ত বে'য়া'দ'ব মেয়ে। আমি এবং আমার দুইটা বান্ধবী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠব কিন্ত এই মেয়ে আর তার বন্ধুরা সিঁড়ি ব্লক করে রেখেছিল। নিজেদের মধ্যে হাসি তা'মা'শায় ব্যস্ত ছিল। আমার একটা ফ্রেন্ড তাদের জায়গা দিতে বললেই এই মেয়েটা জবাব দিল,

-'আপনাদের চোখ নাই? এই খান দিয়ে যে জায়গাটা আছে এটা দিয়ে গেলেই তো পারেন। আজাইরা!'


আমি তাকিয়ে দেখলাম জায়গাটা অতি স্বল্প। আমরা মোটেও যেতে পারব না। তাই বেশ শক্ত গলায় বললাম,

-'তোমরা ফার্স্ট ইয়ার এর?'

-'হ্যাঁ।'

-'সিনিয়রদের যে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তা জানো না? এত বড় হয়েছ অথচ এই আক্কেল টুকু নেই? আর তুমি আমাদের অর্ডার করার কে যে আমরা কোন দিক দিয়ে যাব! সরো, জায়গা ছাড়ো!'


শেষ কথাটা বেশ জোরেই বলেছিলাম। বাকি মেয়েগুলো সুরসুর করে সরে গেল। কিন্তু ওই মেয়েটা সেখানেই দাঁড়িয়ে ফুঁ'স'ছি'ল। আমরা তাকে পরোয়া না করে নিজেদের মতো চলে এলাম। হঠাৎ মেয়েটার এইখানে আসা আমাকে সাফওয়ান ভাইয়ার ডাকা দুইটাই বেশ অস্বাভাবিক লাগল। সম্মান দেওয়া কথাটা ভাবতেই চারে চারে দুই মিলিয়ে নিলাম। বুঝলাম! মেয়েটা হয়তো বিচার দিয়েছে। কিন্তু সাফওয়ান ভাইয়ার কাছে বিচার দিল কেন? সাফওয়ান ভাইয়া ওর কী হয়! প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরছে। 


মেয়েটা আমাকে দেখে হেসে বলল,

-'সিনিয়র আপু! ভালো আছেন? স্লামালিকুম।'


সালামের অবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিল মেয়েটা। তার ঠোঁটের হাসি দেখেই বোঝা গেল আমাকে এখন এখানে কোনো সা'জা দেওয়া হবে। সেই আনন্দেই তার ওইরকম পৈ শা চি ক হাসি। মেয়েটার দিকে তাকালাম না। কথাও বললাম না। সাফওয়ান ভাইয়া বললেন,

-'তা ছড়া! আমাদের একটা ছড়া শোনাও তো। দেখি তুমি কেমন ছড়া পারো!'


সবাই হা হা করে হাসতে লাগল। আমার কি হলো কে জানে! ছোটবেলায় কত কত ছড়া মা আমায় গুলিয়ে খাইয়েছিল আমি সেই সব এই মুহূর্তে ভুলে বসলাম। পুরোপুরি ভুলিনি। আসলে আমি সব কেমন একটা আরেকটার সাথে মিলিয়ে ফেলছি। যেমন আমার মাথায় এই মুহূর্তে ঘুরছে, "কাজলা দিদি কাজলা দিদি পেয়ারা তুমি খাও?" "নোটন নোটন পায়রাগুলি মাঠে পাড়ে ডিম!" "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে খুকুমণি ওঠোরে।"


আমি বুঝতে পারছি কেমন জগা খিঁচুড়ি করে ফেলছি। কিন্তু তবুও তা ঠিক টা করতে পারছিলাম না। কি একটা অবস্থা!


আমার এই দশা দেখে পেছনের দিকে দাঁড়ানো একটা ছেলে বলল,

-'এই ছড়া তো দেখি ছড়া-ই পারে না!'


উপস্থিত সকলে আবার হাসতে লাগল। কি যে একটা অবস্থায় পড়েছি! ল'জ্জা, অ'প'মা'নে আমার মাথা নত হওয়ার উপক্রম। আমার নি'র্লজ্জ চোখের জল গুলোকে যত বেঁধে ধরতে চাইলাম তবুও কেন যেন চোখের কোণে জমাট বাঁধে। সাফওয়ান ভাইয়া আবারও ডাকলেন আমার নাম ধরে,

-'ছড়া!'


আমি চোখ তুলতে চাইছিলাম না। কেউ আমার অশ্রু গুলো দেখুক আমি চাই না। কারণ সেগুলো স্পষ্ট আমার পরাজয় জানান দেয়। সাফওয়ান ভাই এবার ধ'ম'কে উঠলেন,

-'এই মেয়ে ডাকছি যে শোনো না? এদিকে তাকাও!'


আমি প্রাণপণে চোখের অশ্রু গুলো আ'ট'কে রেখে তার দিকে মুখ তুল তাকালাম। তবুও! আমার ছলছল আঁখি তো দিল না ফাঁ'কি। সাফওয়ান ভাইয়া কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন। বোধ হয় আমার সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া দেখে নরম হলেন। মায়া দেখালেন। বললেন,

-'ক্লাসে ফিরে যাও। এক্ষুণি।'


আমি চলে তো এলাম। তবুও তার এই মায়া দেখানোটা স'হ্য করতে পারলাম না। মোট কথা প্রথম সাক্ষাৎে সাফওয়ান ভাইয়াকে বা'জে ভাবে আমার অপছন্দ হলো। পরের এক সপ্তাহ আমি ভার্সিটিতে গেলাম না। না না! ভ'য় বা ল'জ্জায় নয়। আমার চাচাতো বোনের বিয়ে ছিল। গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। উৎসবে আনন্দে আমি বলতে গেলে সাফওয়ান ভাইয়াদের সব কিছু ভুলেই বসেছিলাম। 


এক সপ্তাহ পরে যখন ভার্সিটিতে গেলাম তখন একটা নতুন খবর পেলাম। নয়ন আমাকে দেখেই ছুটে এলো। গল্প করলাম খুব। তারপর তার থেকেই জানলাম সাফওয়ান ভাইয়া নাকি আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে গত সাতদিন যাবৎ ঘোরাফেরা করছেন। প্রথম দুই দিন বেশ সেজেগুজে এলেও পরের দিনগুলোতে নাকি উ'দ্ভ্রা'ন্তের  মতোন এসে হাজির হতেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কেউ প্রশ্ন করার সা'হ'স পেত না। হঠাৎ একদিন তিনি নাকি আমাদের ক্লাসে এসে সরাসরি আমার খোঁজ করলেন। আমাকে না পেয়ে আমার বান্ধবী যারা তাদের ধরল। নয়নকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল আমার কথা আমি কোথায় গিয়েছি। তারপর নাকি যাওয়ার সময় নয়নকে বলে গেল আমি আসলেই নাকি তাকে যেন খবর পাঠানো হয়। নয়ন আমাকে এসব ফোনে বলেনি আসলে বলতে চেয়েছিল পারেনি। আমার ফোনটা কাজিনের হলুদের দিন মেঝেতে পরে একেবারে ঠুস হয়ে গেছে। ঘটনাটা তার পরের দিনই নাকি ঘটেছিল। তাই আমারও আর জানা হয়নি। সব শুনে আমি আসলে কি প্রতিক্রিয়া দিব সেটাই বুঝতে পারলাম না। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম। রিকশায় উঠতেই কেউ একজন দৌঁড়ে এসে রিকশার সামনে দাঁড়ালো। দেখলাম সাফওয়ান ভাইয়া। সুদর্শন সাফওয়ান ভাইয়ার মুখটা কেমন নুয়ে পড়েছে কালচে ছাপে। চোখের নিচে স্পষ্ট ডার্ক সার্কেল দেখা গেল। চুল এলোমেলো। যা একেবারে নতুন দৃশ্য আমার জন্য। এইরকম পা'গ'লাটে চেহারার সাফওয়ান ভাইয়াকে আমি কখনোই দেখিনি। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন,

-'ছড়া তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।'

-'এখন আমার সময় নেই ভাইয়া। বাসায় ফিরতে হবে। গেস্ট আসবে।'

-'গেস্ট আসলে আসুক। তুমি একটু দেরি করলে কিছু তো হবে না। গেস্ট নিশ্চয়ই তোমার কাছে আসবেনা।'


আমি আসলে প্রথমে বলতে চাইনি পরে ভাবলাম না বলার মতো তো কিছু নেই। তাই বললাম,

-'আমাকেই তো দরকার।'

-'মানে?'

-'পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।'

-'কি!'


এত জোরে চিৎকার করলেন আমার কানের পর্দা ফে'টে যেত বোধ হয় আর একটু হলে। রিকশা ওয়ালা মামা তাড়া দিলেন,

-'আপা যাইবেন! যাইলে চলেন। নইলে নামেন। আরেকটা ভাড়া নেই।'

-'আজব! আমি কি ভাড়া দিব না নাকি? চলেন চলেন।'


সাফওয়ান ভাইয়া টুপ করে রিকশায় উঠে পড়লেন। আমি আকস্মিক এমনটা দেখে সরে বসলাম। তবুও গায়ের সাথে গা লেগে গেল। সাথে সাথেই আমার হৃদয়ে ধ'ড়া'ম শব্দ করে উঠল। বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী সাফওয়ান ভাইয়ার সাথে না চাইতেও আমার বাহু ধা'ক্কা খেল। আমি নেমে যেতে চাইলে তিনি তার ডানহাতে আমার কোমর আকড়ে ধরে রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,

-'মামা আপনি চলেন।'


রিকশা চলছে আমি সাফওয়ান ভাইয়ার হাত সরানোর চেষ্টা করছি। লাভ হচ্ছে না কোনো। তিনি বললেন,

-'ছড়া বেশি নড়াচড়া করলে ফেলে দিব। এমনিতেও আমার মাথা গরম।'


আমি এবার চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম,

-'আপনি একটা অ'স'ভ্য লোক। আপনার সা'হ'স হয় কীভাবে আমারে কোমরে হাত দেওয়ার! ছিঃ আপনি এতটা খা'রা'প আমি ভাবতেই পারছিনা।'


সাফওয়ান ভাই আমাকে এবার টেনে আরেকটু কাছে নিয়ে এলেন। বললেন,

-'আমি আরো বেশি খা'রা'প ছড়া। আর অ'স'ভ্যের কথা বলছ? বিশ্বাস করো, তুমিই প্রথম আর তুমিই শেষ। সা'হ'সের কথা বলছ? আমি বলব তোমাকে ধরার সা'হ'স এবং অধিকার সব আমারই।'


তারপর ব্যাকুল হয়ে কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

-'ছড়া! আমি আমার জীবন ভর তোমার সাথে অ'স'ভ্য'তা করার পারমিশন চাইছি। দিবে?'


তারপর? তারপরের গল্পটা একদম অন্যরকম। আমি বর্তমানে সাফওয়ান খানের দুই পুত্রের মা। সেদিন তার প্রস্তাবটা আমি কড়া ভাবে নাকোচ করেছিলাম। কিন্তু সে থামেনি। প্রতিনিয়ত আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করা, সবাইকে আমার নাম ভাবী বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সহ নানান কাজ তিনি করেছেন। ততদিনে আমিও কেন যেন দুর্বল হয়ে পড়লাম। বাসায় আসা দুই তিনটা বিয়ের প্রস্তাব ভেঙেও গেল। আমার কিন্তু ক'ষ্ট হয়নি। যথারীতি ওনার রেজাল্ট বের হয়। সিজিপিএ ফোর! আমি এত খুশি হয়েছিলাম! দেড় মাসের মধ্যে একটা চাকরীও তার হয়ে গেল। তার বাবা-মা বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। এতটা সিরিয়াস ভাবে তিনি আমার প্রেমে পড়েছেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাবা এই প্রস্তাবটা পেয়ে ভীষণ খুশি। অনেকে ভেবেও নিলেন দুজনে আমরা ভার্সিটিতে প্রেমও করেছি। কি ল'জ্জাজনক পরিস্থিতি! বিয়ে হলো, তার বাঁধ ভাঙা খুশি দেখে আমি অবাক হই। এখনও রাতে যখন ঘুমাতে যাই মাঝে মাঝেই তার এক প্রশ্ন,

-'তুমি কি সেদিন খুব বেশি ক'ষ্ট পেয়েছিলে ছড়া?'

-'না।'

-'কিন্তু আমি স্পষ্ট তোমাকে কাঁদতে দেখলাম।'

-'রা'গে।'

-'সত্যি?'

-'সত্যি।'

-'আমি তোমাকে কাঁদিয়ে নিজেই শান্তি পাইনি ছড়া। তোমার চোখে পানি দেখে আমার সত্যিই খুব ক'ষ্ট হয়। কেন হয়? আম্মাকে সেদিন এসে বললাম। তোমার দেখা না পেয়ে পাগল হয়ে পড়েছিলাম। আম্মাই বলল এটাই ভালোবাসা। তোমার কি মনে হয় ছড়া?'


আমি ঠোঁট টিপে হাসি। ভালোবাসি কথাটা সরাসরি এই লোক বলতে পারেনা। পারবে কিনা স ন্দে হ আছে।


আমার শ্বাশুড়ি মা চমৎকার মানুষ। তাকে দেখার ইচ্ছে আমার ছিল তবে শ্বাশুড়ি হিসেবেই যে দেখা হবে তা কি জানতাম? আমি আর আম্মা দুই বান্ধবীর মতোন। আমাদের কত শত গল্প থাকে। আম্মা জানান তার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রথম প্রথম তার বাংলা ভাষা শুনে সবাই হাসতো। আমার শ্বশুর মশাই তার পাশে ছিলেন। বছর দুয়েকের মধ্যেই আম্মা পুরোপুরি বাঙালী বউ হয়ে উঠলেন। আমি সবসময় শাড়ি পরি না কিন্তু তিনি সেই প্রথম থেকে আজ অব্দি যত্নের সাথে শাড়ি পরেন। সংসার সামলান। দেখতেই ভিনদেশী কিন্তু কাজে কর্মে পুরো বাংলাদেশের মানুষই বলা যায় তাকে।


সেদিনের ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েটা হলো আমার চাচাতো ননদ, রাইসা। আমার বিয়ের এতগুলো বছর হয়ে গেল তবুও সে আমাকে দেখলে আগের মতোই ফুঁ'সে ওঠে। আমার বিয়েতে এই মেয়েটা নাকি সবচেয়ে বেশি অখুশি ছিল।


আমার দুই ছেলে। আব্রাহাম আর ইব্রাহীম। তারা দেখতে একদম তাদের বাবা আর দাদির মতোই। আমার ছেলে বলা যায় না তাদের। তারা কেবল তাদের বাবার ছেলে-ই।


আমার সেই প্রথম সাক্ষাৎে বা'জেভাবে অপছন্দ হওয়া পুরুষটাকে দিন যত যায় ততোটাই ভালো লাগে। এত ভালো লাগা কোথা থেকে আসে আমি নিজেই জানিনা। তবে এই ভালোলাগা কেবল ভালোলাগাই নয় ভালোবাসাও বটে। আমি বলিনি, তিনিও বলেন না। বলার কি দরকার? অনুভবই তো করা যায়। সব কথা মুখে বলতে নেই। 


ভালোবাসা আকস্মিক ঘটে। ভালোবাসা বলে কয়ে আসেনা। এই চিরন্তন সত্যটি আমি এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করি। আমার বারবার মনে হয়, ভালোবাসা এত সুন্দর কেন?

!!!!সমাপ্ত!!!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন